মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:: মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ করে গরুর ভাইরাসজনিত রোগ লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) এর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের পাশাপাশি গরু ব্যবসায়ীদের মাঝেও আতংক দেখা দিয়েছে। এ রোগে গত এক সপ্তাহে একই এলাকায় অন্তত ৫টি গরু মারা যাওয়ার নিশ্চিত খবর পাওয়া গিয়েছে। কুরবানী সামনে রেখে অগ্রিম কেনা-বেচায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন ব্যবসায়ীরা।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয় ও বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এলএসডি'তে আক্রান্ত হয়ে গত এক সপ্তাহে গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পৃথক স্থানে ৫টি গরু মারা গিয়েছে। ওই ইউনিয়নসহ প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়নে এলএসডি'তে গরু আক্রান্ত রয়েছে। তবে প্রতিবছরই কুরবানির সময় গরুর হাটে মাইকিং করে রোগে আক্রান্ত গরু বেচা-কেনা করতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১৬ সালের দিকে প্রথম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ঝিনাইদহ, যশোর জেলায় গরুর মধ্যে এলএসডি শনাক্ত হয়। ভারত থেকে এই রোগ দেশের গরুর মধ্যে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এলএসডি একধরনের ভাইরাসজনিত রোগ। এটি গরুর একধরনের চর্মরোগ। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ যেমন মশা ও বিশেষ প্রজাতির মাছি ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। এ ধরনের কীটপতঙ্গ আক্রান্ত গরুকে দংশন করার পর অন্য একটি সুস্থ গরুকে দংশন করলে সেই গরুটিও আক্রান্ত হয়। আবার আক্রান্ত গরুর লালা খাবারে মিশে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়চোপড়ের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গাভির দুধেও এই ভাইরাস বিদ্যমান। তাই আক্রান্ত গাভির দুধ খেয়ে বাছুর আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গরুর সিমেনও (বীর্য) এই রোগের অন্যতম বাহন।
প্রাণিচিকিৎসকেরা বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণ হলো জ্বর। এরপর ত্বকের ওপরে বড় মাপের ফোড়া বা গোটা তৈরি হয়। মানুষের জলবসন্ত হলে যেমন হয়, এটি অনেকটা তার কাছাকাছি। শরীরজুড়েই গোটা তৈরি হতে থাকে। কয়েক দিনের মাথায় সেগুলো ফেটে তরল নিঃসৃত হতে থাকে। এর কিছুদিন পরে ওই গোটা বা ঘা ধীরে ধীরে শুকায়। এলএসডি সব গরুর ক্ষেত্রে এক রকম নয়। কোনো কোনো গরু বিশেষ করে যেসব গরু প্রথমবার আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ মারাত্মক আকার নিতে পারে। এমন ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার বেশি। আক্রান্ত গরুর শরীরে ফোসকা পড়ে যায়। কোনো গরুর পা, অণ্ডকোষ ফুলে যায়, কোনো গরুর গলায় ঘা হয়। কিছু কিছু আক্রান্ত গরুর চামড়ার নিচে পচন ধরে। সঠিক চিকিৎসা না হলে গরু দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় গরুর মৃত্যুসহ নানা মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক গরুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে, এতে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। গর্ভবতী প্রাণীদের গর্ভপাত হতে পারে। রোগের তীব্রতা কম হলে যথাযথ চিকিৎসায় এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে এবং তীব্রতা বেশি হলে এক থেকে দেড় মাসে আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়ে ওঠে।
উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের লাঠিটিলা গ্রামের সমছুল ইসলাম জানান, তাঁর ৫টি গরু অসুস্থ ছিল। একটি মারা গিয়েছে এবং বাকি ৪টি গরুর অবস্থা গুরুতর। একই গ্রামের সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। দেশে এসে ভেবেছিলেন গরুর খামার করবেন। এই চিন্তা নিয়ে ৩টি গরু কিনেছেন। লাম্পি স্কিন ভাইরাসে একটি গরু মারা গিয়েছে এবং বাকি ২টার অবস্থা আশংকাজনক। খামার করে পরিবার চালানো কঠিন হতে পারে চিন্তা করে বিকল্প ব্যাবসা নিয়ে ভাবছেন তিনি। ডোমাবাড়ী গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, আমরা ১১ জন সদস্য নিয়ে একটা সমিতি করে প্রথমে একটি গরু কিনেছিলাম। এ রোগে গরুটি মারা গিয়েছে। স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী আমির আলী জানান, রোগের প্রকোপ বাড়ছে। অন্যান্য বছর আমরা দুই-তিনমাস আগে গরু কিনে লালনপালন করে কুরবানির হাটে বিক্রি করতাম। এবার মাত্র কয়েকটি গরু কিনেছি। এ রোগে আক্রান্ত হলে গরুর শরীরে গুটি দেখা যায়, তখন ক্রেতারা কিনতে চাননা।
উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা রমা পদ দে জানান, লাম্পি স্কিন এখন নিয়মিত একটি রোগ হয়ে গিয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্তের তথ্য আমাদের কাছে আছে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীদের সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া আছে। আর সুস্থ গরু যাতে আক্রান্ত না হয় সেজন্য ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলমান আছে।
0 মন্তব্যসমূহ